জুল রেনার : “কয়েক টুকরো ছেঁড়া মেঘ” থেকে নির্বাচিত অংশ
উদ্ধত, গম্ভীর মুখ দেখে ঠকবেন না— এই মুখগুলিই ভীরু।
কখনও-সখনও চারপাশে সব কিছু বড় বিকীর্ণ মনে হয়, মনে হয় বড় কম্পমান, বড় কম কঠিন; এবং তা এতটাই যে, এ পৃথিবীকে মনে হয় আগতপ্রায় এক পৃথিবীর মরীচিকা মাত্র, তার প্রক্ষেপণ শুধু। আমরা যেন অরণ্য থেকে বহু দূরে দাঁড়িয়ে; এবং যদিও মহাদ্রুমের দীর্ঘ ছায়া এসে পড়েছে আমাদের উপর, এখনও যেতে হবে বহু দীর্ঘ পথ যাতে তাদের ডালপালার নিচে হাঁটতে পারি।
চিন্তার খুচরো ভাঙানি হল শব্দ। এক-একজন কথক আমাদের দেন সিকি আধুলি। আবার কেউ-কেউ দেন শুধুই স্বর্ণমুদ্রা।
পণ্ডিত সাধারণীকরণ করেন, শিল্পী চিহ্নিত করেন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য দিয়ে।
নিজের মাথাটা আকর্ষণীয় করে তুলতে হলে তাকে সাবধানে চুল ছাঁটতে হবে সব দিকে, শুধু এদিক-সেদিক কয়েক গোছা চুল বাঁচিয়ে, যাতে তারা খাড়া প্রতিবাদী থেকে জানান দিতে পারে তার চিন্তার উৎকেন্দ্রিকতা এবং তার উদ্দেশ্যের বেপরোয়াপনা।
বাস্তববাদ! বাস্তববাদ! আমাকে একটি উৎকৃষ্ট বাস্তব দিন যা অনুসরণ করে নিজেকে গড়ে তুলতে পারি।
শৈলীর অর্থ যাবতীয় শৈলী ভুলে যাওয়া।
সমালোচক উদ্ভিদ্বিজ্ঞানী, আমি উদ্যানপালক।
কখনও সন্তুষ্ট হলে চলবে না : যাবতীয় শিল্প নিহিত এখানেই।
চাষি হল চলমান গাছের গুঁড়ি।
প্রতিদিনের বরাদ্দ পৃষ্ঠাটা লেখা চাই : কিন্তু যদি মনে হয় লেখাটা খারাপ হচ্ছে, থেমে যেতে হবে সঙ্গে-সঙ্গে। ঘাবড়ানোর কিছু নেই। একটা দিন নষ্ট হল ঠিকই, কিন্তু খারাপ কিছু করার থেকে কিছু না করা ভালো।
আমি এমন এক বাস্তববাদী যে বিব্রত বাস্তবে।
যাবতীয় দেশপ্রেমের মূল রয়েছে যুদ্ধে : তাই আমি দেশপ্রেমিক নই।
যেদিন থেকে কৃষককে চিনেছি, প্রকৃতি-বিষয়ক যে-কোন রচনা, তা যদি নিজেরও হয়, মনে হয়েছে মিথ্যা।
যদি ঈশ্বরের সঙ্গে বন্দোবস্ত করতে পারতাম তবে তাঁকে বলতাম যেন আমাকে তিনি গাছে রূপান্তরিত করেন, এমন একটি গাছ যা ক্রোয়াসেৎ-এর উচ্চতা থেকে তাকিয়ে থাকবে আমাদের গ্রামের পানে। হ্যাঁ, একটা মূর্তির তুলনায় এটাই আমার পছন্দের।
কোন কাজের জন্ম ও বৃদ্ধি গাছের মতো হওয়া উচিত। বাতাসে এমন কোন অদৃশ্য রেখা নেই যা বরাবর ডালপালা ছড়াবে
নিজের : গাছের উদ্ভব সম্পূর্ণত তার ধারক বীজ থেকে, তারপর সে খোলা বাতাসে বেড়ে ওঠে স্বাধীন ভাবে। বাগানের মালিই শুধু নকশা সাজায়, বানায় তার বেড়ে ওঠার পথ, তাকে নষ্ট করে।
আঃ! যত্ত-সব পুরনো আবর্জনা! পুরনো চিঠিপত্র, পুরনো জামা-কাপড়, পুরনো টুকিটাকি জিনিস যা ফেলে দিতে চায় না কেউ। ব্যাপারটা কী সুন্দর ভাবে বুঝেছে প্রকৃতি, আর তাই প্রতি বছর সে অতি অবশ্যই মোচন করে পুরনো পাতা, ফুল ফল শাকসবজি, এবং পুরনো বছরের স্মৃতিচিহ্ন দিয়ে প্রস্তুত করে জমির সার।
সমাজতন্ত্রীগণ, আপনাদের সঙ্গে আমার সহমত হওয়া আর হয়ে উঠবে না। আপনারা চান আরও অর্থবান হতে, আমি দরিদ্রতর হতে বদ্ধপরিকর। আমার আগে আপনারা গন্তব্যে পৌঁছবেন।
সমাজতন্ত্রীদের প্রতি : “হ্যাঁ, অবশ্যই আমরা ভাগাভাগি করব! কিন্তু সেই সঙ্গে আনুগত্য, ভদ্রতা ও সরসতাও ভাগাভাগি করা উচিত!”
আলস্য! আহা! এ বিষয়ে আমাকে একটি বই লিখতে হবে! যে-মূর্খ নিজের মূর্খামি বুঝতে পারে তাকে ঠিক মূর্খ বলা চলে না আর; কিন্তু অলস ব্যক্তি নিজের আলস্য সম্পর্কে সজাগ থাকে, তা নিয়ে শোকসন্তপ্ত হয়, এবং অলস-ই থেকে যায়।
আলস্য নিষ্ফলা, এমন ভাবা উচিত নয়। এর মধ্যে নিবিড় ভাবে বাঁচা যায়, কানখাড়া খরগোশের মতো। জলে সাঁতার কাটার মতো এরও মধ্যে কাটা যায় সাঁতার; গায়ে ছুঁয়ে যায় আত্মভৎসনার তৃণগুচ্ছ।
যে-শব্দটি সর্বাধিক সত্য, সর্বাধিক সুনির্দিষ্ট, সর্বাধিক বোধযুক্ত, তার নাম ‘শূন্য’।
ভবিষ্যৎ সমাজ দেখার জন্য আমার তাড়া নেই বিশেষ : লেখক-কুলের পক্ষে বর্তমান সমাজ যথেষ্ট সহায়ক। তার আজগুবিপনা, তার অবিচার, তার অনৈতিকতা, তার নির্বুদ্ধিতা, সবই একজন লেখকের নিরীক্ষার বিষয় সরবরাহ করে। মানুষ যত উন্নত হবে, বিবর্ণ হবে তত।
আমার স্মৃতিশক্তি অসাধারণ : সবই ভুলে যাই! ব্যাপারটা চমৎকার সুবিধাজনক। যেন জগৎ আমার কাছে পুনর্নবীকৃত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
সূত্র :
বইপত্তর-প্রকাশিত শান্তনু গঙ্গোপাধ্যায়ের তরজমায় “জুল রেনার : কয়েক টুকরো ছেঁড়া মেঘ নির্বাচিত দিনলিপি” থেকে সংকলিত কিছু অংশ।
বইটি কেনা যাবে এই লিঙ্ক থেকে : https://www.boipattor.in/product/jules-renard-koyek-tukro-chenra-megh/