নবারুণ ভট্টাচার্য : আমার দেশটা একটা অবর্ণনীয় ট্র্যাজেডির দিকে এগোচ্ছে

বিশ্বায়ন নিয়ে অনেক কিছুই বলা হয়ে গেছে। তা হলেও কয়েকটা কথা— একদম সূত্রাকারে কয়েকটা কথা বলি। এই বিশ্বায়ন নিয়ে অনেক কথা হয়, বিশ্বায়ন কী, কেন— তাই নিয়ে ব্যাখ্যার আর শেষ নেই। অ্যামেরিকাতে, একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাছে হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন, বিশ্বায়ন (মানে গ্লোবালাইজেশন)-এর অর্থ হচ্ছে— অ্যামেরিকান ডমিনেশন অফ দ্য ওয়ার্লড। এইটা হচ্ছে সরাসরি একটা স্পষ্ট বক্তব্য, এর পর আর কোন প্রশ্ন ওঠে না। আজকের বিশ্বে যা কিছু ঘটছে— সে ইরাকের যুদ্ধ বলুন, শ্রীলংকার ঘটনা বলুন, লালগড়ের ঘটনা বলুন, গুরগাঁওতে শ্রমিকদের আন্দোলন বলুন— সমস্ত কিছু একটা বিশ্বায়নের আওতায় ঘটছে। কী ঘটছে?— আসছি কথাটায়, আর একটু ঘুরে আসি।

দেখুন, আমি যা বুঝি, আমি সেই খুব যুবক বয়সে কমিউনিস্ট মানিফেস্টো পড়তে গিয়ে, অনেক কিছু বুঝতে পারছি না, কিন্তু একটা জায়গা, সে জায়গাটা এত কাব্যিক যা আমাকে ভীষণ ভাবে আকৃষ্ট করেছিল—

When everything solid melts into air
Everything holy is turned profane

এ রকম একটা অবস্থা যখন সব কিছু যা নিরেট কঠিন সব বায়বীয় হয়ে যায়, যা কিছু পবিত্র পুণ্য সমস্ত কিছু কলুষিত হয়। এ রকম একটা অবস্থা। সেদিন আমাকে শুধু মার্কসের এই চিত্রকল্পটা আকৃষ্ট করেছিল। আজকে আমি বুঝতে পারি, তার মধ্যে কতটা সত্যি ছিল। আমাদের চোখের ওপর সমস্ত কিছু উবে যাচ্ছে। আমাদের রাষ্ট্রটার কথা ধরুন। আমি আমার ছোটবেলা থেকে, অন্তত একটা ওয়েলফেয়ার স্টেট-এর আদলওলা রাষ্ট্র দেখেছি। আমি একটা সরকারি স্কুলে পড়তাম। আমাদের মাইনে ছিল সামান্য। আমাদের বিনাপয়সায় টিফিন খেতে দিত। তখন কলকাতায় বাড়িতে বাড়িতে টিকে দিয়ে যেত। অনেক ওষুধ বিনাপয়সায় পাওয়া যেত। সেই ওয়েলফেয়ার স্টেট-টা, আমার চোখের ওপর দেখলাম, একটা  ওয়ারফেয়ার স্টেট হয়ে গেল। একটা যুদ্ধবাজ দেশে পরিণত হল। আজকে হয়নি, অনেক দিন ধরে হচ্ছে, আস্তে-আস্তে হচ্ছে। এই রেডিও কমানো-বাড়ানোর মতো, কখনো বাড়ে, কখনো কমে।

১৯৭০ সালে (বা ৭১ সালে ) আমি কলকাতায় আর্মি নামতে দেখেছি নকশাল আন্দোলনকে দমন করার জন্য। আমার বাড়ির সামনে দিয়ে আর্মির ট্রাক গেছে সাবমেশিনগান নিয়ে। কাজেই আমার কাছে এই ঘটনা নতুন না, এই রাষ্ট্র আমার কাছে নতুন না। আমি শুধু তার পরিণতিটা দেখছি। বিশ্বায়নের আওতায় সে কতটা নোংরা, কতটা বীভৎস, কতটা মিথ্যেবাদী, কতটা জোচ্চর, কতটা প্রতারক হয়ে উঠেছে।

আজকাল একটা কথা চলছে, চিদাম্বরম আছেন, আরও বড়-বড় লোক আছেন, মমতা ব্যানার্জী আছেন, অনেকেই— । কী? না , মাওবাদীদের সঙ্গে আলোচনা! আমরা সামান্য লোক, কিন্তু আমাদের সাধ্যমতো আমরাও মাওবাদীদের সঙ্গে ইতিমধ্যেই আলোচনা করেছি। আমরা নামও বলে দিতে পারি, তাদের কেউ-কেউ আপনাদের এই মেদিনীপুর জেলে আছেন। যেদিন সেই দু-জন ভোটকর্মীকে মাইন দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়, সেই দিন আমার কাছে লালগড় থেকে একটা ফোন গিয়েছিল। তখন আমি বলেছিলাম— ‘এটা তোরা কী করলি?’ তখন সে আমাকে তার উত্তরে বলেছিল— ‘এটা ভুল হয়েছে, খুব অন্যায় হয়েছে।’  কে বলেছে, তারা কথা বলে না?  আর-একটা কথা বলি, এই গ্রামের মানুষগুলো জন্ম থেকে দেখেছে তাদের গ্রামে পুলিশ আসে, মারে। আজকে সেই পুলিশকে ঠেকাবার জন্যে তারা যদি নিজেদের পুলিশ তৈরি করে, আমি তাদের সম্পূর্ণ সমর্থন জানাই, তাতে যা হয় হবে। এইটা হচ্ছে আমার আবেগের কথা, নৈতিকতার কথা। আমার হাজার সমালোচনা মাওবাদীদের সম্বন্ধে আছে। কিন্তু তাদের আত্মত্যাগ?  আমি কতগুলো জিনিস জীবনে ভুলতে পারি না। আমি লালগড়ে একটা মিটিং-এ গিয়েছিলাম। ঐ ছত্রধর নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে মঞ্চে ঐ ছেলেটা ছিল— যে মারা গেল— সিধু সোরেন। আমার মনে আছে, সিধু একেবারেই টগবগে যুবক, এবং ঐ বয়সে আমরা যে-রকম ছিলাম, একটু উদ্ধত ভাব। কিন্তু তার চোখের মধ্যে একটা স্বপ্ন ছিল। ওর তাকানো, যখন ভাষণ দিচ্ছে, ও মানুষগুলোকে ছাপিয়ে একটা কিছু দেখছে। এই ধরনের একটা ভিশন আমি চে গ্যেভারা-র ছবির মধ্যে খুঁজে পাই। বিপ্লবী হতে গেল একটু রোমান্টিক হতে হয়। কাটখোট্টা ক্যালকুলেশন করে বিপ্লব করা যায় না। সে চেষ্টাটা করেছে, বিফল হয়েছে তো কী হয়েছে? চে গ্যেভারা-ও তো বিফল হয়েছিল। এগুলো হয়, এই ভাবেই ইতিহাস এগোয়।

যাই হোক, বলেছিলাম কথাটায় ফিরব, তা সেই বিশ্বায়নের আওতায় এখন যেটা আমরা দেখছি, এই প্রক্রিয়াটাকে আমরা বলতে পারি, ইন্টারন্যাল কলোনিয়ালিজম। একটা অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদ। সেটা কী? না, দেশের মধ্যে, একটা ইউনিটের মধ্যে অপেক্ষাকৃত যে কম অংশ, যে দুর্বল, যার হাতে অস্ত্রশস্ত্র নেই, যার অত প্রভাব-প্রতিপত্তি নেই, যাকে টেলিভিশনে দেখায় না—মানে বন্যায়-টন্যায় না ডুবে মরলে খবরের কাগজে জায়গা পায় না, সেই লোকগুলোকে, তাদের জায়গাগুলোকে দখল করো। সোজা কথা, তার ওখানে যদি অর্থনৈতিক সম্পদ থাকে সেটাকে দখল করো। এগুলো নাও, এগুলো কাড়ো! এই প্রক্রিয়াটা তৃতীয় বিশ্ব জুড়ে চলছে। আফ্রিকাতে আফ্রিকার মতো করে চলছে, ল্যাটিন আমেরিকাতে ল্যাটিন আমেরিকার মতো করে চলছে। তার জন্য এই গভর্নমেন্ট যেটা করে, সেটা হচ্ছে স্টেট টেররিজম। এই স্টেট টেরর করার একটা সুবিধে আছে। এই ভদ্রলোক, মার্শেলো পোলো, যিনি স্পেন-এ পড়ান এবং এই বিষয়ে একজন অথরিটি, তিনি বলছেন, এই যে ট্যাকটিকস, গভর্নমেন্টের, এর ফলে কী হয়, গভর্নমেন্ট-এর ডিফেন্স, পার্সোন্যাল ফ্রিডম, এবং মানুষের সেফটি— এইগুলো নিয়ে যে দায়দায়িত্ব, সেগুলো এড়িয়ে চলা যায়! খুব সহজে আজাদকে মেরে দেওয়া যায় জঙ্গলের মধ্যে। উমাকান্তকে কী করে মেরেছে আমি জানি না, কিন্তু মেরে দেওয়া যায়। তার কোনো লিগাল দায়দায়িত্ব আমি নেব না। এইটা টেররের একটা বিরাট দিক, এবং এই কারণে স্টেট টেরর বিভিন্ন তৃতীয় বিশ্বের দেশে, সেখানকার সরকাররা কাজে লাগিয়েছে। আর্জেন্টিনাতে হাজার-হাজার ছেলেকে ড্রাগ করে হেলিকপ্টার থেকে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়েছে। মেদিনীপুর থেকেও মানুষকে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়নি, এ রকম নয়।

এ রকম ঘটনাগুলো ঘটছে আমাদের চোখের ওপর। আমরা এগুলো মেনে নিয়েছি। মেনে নিচ্ছি কেন বলুন তো? আমরা ক্যালাস! এইখানে আমার— আমাদের যে বুদ্ধিজীবী, যাদের খুব বড় করে দেখায়, নামডাক শুনি— তাদের বিরুদ্ধে একটা সিরিয়াস এক্যুইজিশন আছে। আপনারা এইটার সম্বন্ধে কি এতটাই সচেতন? হলে, আপনারা ওরকম অ্যাবসোলিউটির জায়গা থেকে ‘লেগে যা লেগে যা, নারদ নারদ’ ভাব নিতেন না। অথবা, ভোটের পর কে জিতবে, তাই নিয়ে ছক করতেন না। আপনারা ট্র্যাজেডিটা বুঝুন। এটা লালগড়ে গিয়ে একটা মানুষকে মারা শুধু নয়, এবং সেই মারারও রকমফের আছে। জেলে যখন ধরে নিয়ে যায়, যারা আদিবাসী তাদের বেধড়ক মারে! যারা মধ্যবিত্ত, একটু বুদ্ধিজীবী ঘেঁসাটেসা, তাদের মারে না। এটাও একটা ট্যাকটিকস, এদের মধ্যে বিভেদ লাগিয়ে দাও। এই যে ঘটনা, এটা একপেশে একটা যৌথবাহিনী যাচ্ছে— অত্যাচার শুধু— তাই নয়। চিন্তা করুন, মধ্যপ্রদেশ উড়িষ্যা এই সব জায়গা থাকতে হাজারে-হাজারে মানুষ উৎখাত হয়ে চলে গেছে। কোথায় গেছে? কী করবে? সে কি জানে— এই দেশের ভূগোল? এই দেশের নিয়ম? কিচ্ছু জানে না। এবং একটা কোনো সংগঠিত, একটা কোনো অর্গানাইজড প্ল্যানে তারা যাচ্ছে না। একটা ফ্যামিলি ইউনিট পালাল রাত্রিবেলা। কোথায় গেল? স্টেশনে গেল, কোনো একটা ট্রেনে উঠল, নামিয়ে দিল আননোন স্টেশনে। এ রকম করতে-করতে, কোনো একটা জায়গায় গিয়ে পৌঁছল। মোস্টলি গিয়ে পৌঁছয় বড় বড় শহরগুলোয়। এমন করে, সেই শহরের যে আবর্ত, যে ভয়াবহতা, যে ভয়ংকর পাপের কুণ্ড তার মধ্যে তলিয়ে নিঃশেষ হয়ে যায়, নিখোঁজ হয়ে যায়। এইটার একটা প্রমাণ পাবেন, দিল্লীতে প্রবাসী বাঙালি বলতে কাদের বোঝায়? যারা বড়-বড় চাকরি করে? চিত্তরঞ্জন পার্কে থাকে আর দুর্গাপুজো করে? তার থেকে দশ গুণ বাঙালি রাস্তায় রিক্সা চালায়। তাদের কথা কেউ বলে না। কেন বলে না? তারা হিশেবে আসে না। এই হিশেবের বাইরের মানুষ, তারা ক্রমশ ছড়িয়ে যাচ্ছে নানাদিকে, এবং আমার দেশটা একটা অবর্ণনীয় ট্র্যাজেডির দিকে এগোচ্ছে। এই অবস্থাতে আমি মনে করি না, বুদ্ধিজীবীদের কোনো দর কষাকষির মধ্যে ঢোকা উচিত, এবং ফাঁকা আওয়াজ দেওয়া উচিত। তারা যদি আলোচনায় সহায়তা করতে চান, সিরিয়াস হোন। এরকম কথা বলবেন না যে মাওবাদীরা কী চায় আমি জানি না, কিন্তু আমি নেগোশিয়েসনে থাকব। মানে কী? জানেন না, আসবেন না। কে আপনাকে মাথার দিব্যি দিয়েছে আসতে হবে? আমাদের এই যে বেলুন পুজো, এইটাকে বন্ধ করার দরকার এবং একটু নিজেদের দাপট, নিজেদের ক্ষমতা এইগুলোর দিকে তাকানো দরকার। আজকে ইমপিরিয়ালিস্ট প্রটেকশন, এই যে সারোগেট একটা পাওয়ার স্ট্রাকচার তৈরি হচ্ছে, যার হাজারটা গালভরা নাম আছে! ওই যে কালকে কলকাতায় এসেছিল, মন্টেক সিং আলুয়ালিয়া— ঐ নিওলিবারাল ইকোনমি— এই সমস্ত লোকের থিয়োরি, তত্ত্ব, হাস্যকর কথা! এই যে অমর্ত্য সেনের মতো শিক্ষিত লোক, তিনি বলছেন ল্যাঙ্কাশায়ারে রক্তপাত হয়েছিল। আমি বললাম, তাতে আমার কী?  আপনি নোবেল প্রাইজ পেতে পারেন, কিন্তু আপনি নন্দীগ্রামের রক্তপাতকে জাস্টিফাই করতে পারেন না। আপনি নোবেল প্রাইজ পান, আর যে-প্রাইজ পান, আমার এগুলো জানার দরকার নেই। কাজেই এই জিনিসটা, এবং বুদ্ধিজীবীদের প্রতি আমার যেটা আবেদন এই সময়, মনে রাখবেন, এই যে নিওলিবারেল ইকোনমির ঠ্যালা, সেই একানব্বই সাল থেকে, চালু হয়ে গেল। ইনি করলেন, মনমোহন সিং, তার উপরে ছিল নরসিমা রাও— এই যে চালু হল। সে একানব্বই সালে, সোশ্যালিস্ট ব্লক-এর পতন ঘটছে, চীন তার রাস্তা থেকে ডেভিয়েট করছে— এই সমস্ত কিছু একটা ওয়েল অর্কেস্ট্রেটেড সিনারিওর মধ্য দিয়ে হচ্ছে। এ রকম করে একটা স্ট্রাকচার তৈরি হয়েছে সমগ্র তৃতীয় বিশ্ব জুড়ে। তার ফলে, কোনো দেশের নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে, যেমন ১৯৭৩ সালে, খুন করে কার্পেটের ওপর দিয়ে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া যায়, সালভাদোর আলিয়েন্দের মতো। সে রকম একটা দেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে গিয়ে, ফাঁসিতে তার মুণ্ডটা বডির থেকে আলাদা করে দেওয়া যায়, সাদ্দাম হোসেনকে যেটা করা হয়েছিল। তারই একটা রকমফের আমার এখানে আমি আমাদের মতো করে দেখছি।

একটা কথা আমি বলি। আমরা অনেকগুলো জিনিস খবরের কাগজে দেখি। সারফেসে দেখি, তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যাই। আমাদের আর কিন্তু প্রভাবিত হওয়া উচিত নয়, একদম নয়। ওরা চব্বিশ ঘন্টা ভুল বোঝায়, চব্বিশ ঘন্টা বিপরীত কথা বলে। এই বলছে, আলোচনা করবে। এই বলছে, হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হবে, কিন্তু হেলিকপ্টারে বন্দুক থাকবে। আবার বলছে, না, যদি নিচু থেকে গুলি ছোঁড়ে তা হলে বন্দুক থাকবে। এয়ারওয়াইজ মার্শাল বলছে, আড়াইশো পাউন্ডের বোমা মারব না, মারলে পাশের তিন-চারটা গ্রামের লোক মারা যাবে। ভাবুন, কত রকমের বিপরীতধর্মী কথা। আপনারা খুঁজুন, তথ্যের একেবারে টনটন হয়ে গেছে। এই সমস্ত কিছুর আবর্তে পড়ে আমরা একদম দিশেহারা। এই দিশেহারা মানুষের জন্যে কী দরকার? দিশেহারা মানুষকে নেশায় বুঁদ করে রাখার জন্য যেমন মদের দোকান দরকার, সে রকম টেলিভিশন সিরিয়াল দরকার। সোপ ওপেরা দরকার, নোংরা প্রোগ্রাম দরকার, ব্লু-ফিল্ম দরকার। এগুলোর অঢেল সাপ্লাই বা বিশাল বিতরণের ব্যবস্থা দরকার। মানুষ যদি চুপ করে যায়, মানুষ যদি একটা ধোঁয়ার মধ্যে থাকে, সে কোনো প্রশ্ন করবে না।

এই রকম করে আমাদের সমাজটাকে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। অদ্ভুত-অদ্ভুত শব্দের ইমপোর্ট ঘটিয়ে ব্যাপারটিকে গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। চিরদিন, বাংলায় বুদ্ধিজীবীরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে। রবীন্দ্রনাথ সিভিল সোসাইটি শব্দটা জানতেন না, জানার দরকার হয়নি। যখন দরকার ছিল, প্রতিবাদ করেছেন। আজকে হঠাৎ অ্যাংলো-অ্যামেরিকান কনোটেশনের একটা শব্দকে এখানে এনে—‘আমরা কি সত্যিই সিভিল সোসাইটি ?’ আরে ঘ্যাঁচুকলা, আমার কী দরকার সিভিল সোসাইটি হওয়ার? আমি আমার দেশের মানুষ, যে-ভাবে আমি ফিল করি, আমি বলব। আমরা কি সর্বক্ষেত্রে ওয়েস্টকে কপি করতে পারি? সিভিল সোসাইটি কী? সিভিল সোসাইটি, পশ্চিমি সংজ্ঞায় হচ্ছে, পারিবারিক স্যাংটিটির আলাদা জগৎ সেইটা এবং স্টেটের অফিসিয়াল জগৎ, এদের মধ্যে যারা থাকে। ঠিক আছে, ভাল কথা, আমাদের দেশে কি ভার্বেটিম সেগুলো হয়? আপনাদের কি মনে হচ্ছে, এই পরিবর্তনকামী এবং পরিবর্তনবিরোধী বুদ্ধিজীবীদের দেখে, এদের ওপর সিভিল সোসাইটির দায়িত্ব দেওয়া উচিত, না কি যায়? আপনারা এটা নিয়ে ভাবুন।

বহুদিন আগে একজন গান্ধিবাদী অর্থনীতিবিদ গৌতম দিওয়ান, তিনি ইকনমিক পলিটিক্যাল উইকলি-তে একটা চিঠি লিখেছিলেন। আমি যেটা নিজেও অনুভব করি। উনি বলেছিলেন, আজকের ভারতে সবচেয়ে বড় বিপদ, NRI-দের কাছ থেকে নয়, RNI-দের কাছ থেকে। RNI কারা ? RNI হচ্ছে Resident Non-Indians। ভারতবর্ষে থাকে, ভারতবর্ষের খায়, ভারতবর্ষে পাঁচ লক্ষ টাকা মাইনে পায়, কিন্তু মনে-প্রাণে, কাজে-কর্মে সব দিকে তারা অ্যামেরিকান। এই শ্রেণিটাকে স্ট্রেনদেন করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ইউক্রেন থেকে লোক আনো, এনে গভর্নমেন্ট চালাও। দে আর দ্য ম্যানেজারিয়াল ক্লাস, তারা চালাতে পারবে। চক্রান্তটা একটাই, শুধু যৌথবাহিনী ঢুকিয়ে দিলাম তা নয়। এটা একটা বহুমাত্রিক, বহুমুখী চক্রান্ত। ঐ যে, পল বেরিয়েছে না, অক্টোপাস? এরা পলের থেকে অনেক বড় অক্টোপাস, এবং এদের স্পেকুলেশন করার ক্ষমতা পলের থেকে অনেক বেশি। কাজেই আজকে যে বড় লড়াইটার কথা কেউ-কেউ বলছেন, যে বড় লড়াইটা আমরা স্বপ্নে দেখি, সেই লড়াইটাকে মনে রাখতে হবে। ওয়ার্কিং ক্লাস একটা বড় রোল প্লে করবে, এবং তাতে এই যে গরিব— সে গ্রামের গরিব হোক, আর শহরের গরিব হোক— সবাই তার সঙ্গে যুক্ত হবে। তার সঙ্গে দরিদ্র কৃষক যুক্ত হবে, শহরের মধ্যবিত্ত যুক্ত হবে, এবং সেই দিন আসছে। সেই দিন, যে-দিন প্রত্যেকে আলাদা-আলাদা করে কোনো সুড়সুড়ির মজা পাবে না, যে-দিন প্রত্যেকের পিঠে একটা গরম ইস্ত্রি এসে পড়বে। সে দিনটা খুব দূরে নয়। এই চালের দাম বোধ হয় পঞ্চাশ থেকে ষাট টাকা হলেই বোঝা যাবে এটা কী দাঁড়ায়! এবং মনে রাখবেন, এই ঘটনা ব্রাজিলে হয়েছে, চিলিতে হয়েছে, আর্জেন্টিনায় হয়েছে, হাইতিতে হয়েছে, উরুগুয়েতে হয়েছে, গুয়াতেমালাতে হয়েছে। একটা দেশে পারেনি, খুব ভালো ভাবে করতে, নিকারাগুয়াতে। সেখানে একটু পিছু হটতে হয়েছে। ভেনেজুয়েলাতেও পারছে না। আর, কিউবাতে তো প্রশ্নই ওঠে না। কাজেই, আমাদের পক্ষেও তথ্য নেই, ইতিহাস নেই, রশদ নেই— এ রকম নয়। অনেক বেশি সাবধান হয়ে, অনেক আটঘাট বেঁধে আমাদের সামনের দিনটার কথা ভাবা উচিত। এই লড়াইটাকে কোনো মতে অর্থনীতিবাদের মধ্যে আটকে রাখলে হবে না। চে গ্যেভারা একটা কথা বলেছিলেন, আমার খুব ভাল লাগে এ কথাটা। বলেছিলেন, মানুষকে খাওয়ানো-পরানোটা যদি একমাত্র সমস্যা হয়, তা হলে একটা ইন্টেলিজেন্ট ফর্ম অফ নিও-ক্যাপিটালিজম ক্যান ডু ইট! এরা ঠিক ব্যবস্থা করে দেবে, দু-বেলা দু-মুঠো খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে। সেটা আমাদের লক্ষ্য নয়। আমাদের লক্ষ্য নতুন মানুষ তৈরি করা, যে-মানুষ অন্যের জন্য বাঁচার মধ্যে নিজের জীবনটার সার্থকতা খুঁজে পাবে। তা না হলে, মানুষ হয়ে বেঁচে কোনো লাভ নেই।

…   …  …

(২০১০ সালের ১২ সেপ্টেম্বর মেদিনীপুর শহরের রবীন্দ্রনিলয়ে, ‘বিশ্বায়ন ও সন্ত্রাসবাদ’ শিরোনামে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল ‘মেদিনীপুর লেখক শিল্পী সমন্বয় মঞ্চ’। সেই সভায়, নবারুণ ভট্টাচার্য এই বক্তব্য রেখেছিলেন। বক্তব্যের শিরোনামটি এখানে নতুন ভাবে সংযোজিত হয়েছে। এটি লিপিবদ্ধ করেন স্বর্ণেন্দু সেনগুপ্ত। ‘ভাষাবন্ধন’-এর সাম্প্রতিক সংখ্যায় প্রকাশিত।)

Leave a Reply

Shop
Sidebar
0 Wishlist
0 Cart