ভলতের : “নিজের বাগান চাষ” থেকে নির্বাচিত কিছু অংশ

ধর্মের সার কথা হল সাধুকর্ম করা, যা নিয়ে কারও কোন দ্বিমত নেই; যাবতীয় ঝগড়াঝাটিই বুদ্ধির অগম্য গোঁড়ামি নিয়ে। যদি এটুকু বলেই ধর্ম ক্ষান্ত হত যে ন্যায়বান হও, তবে পৃথিবীর বুকে কোন অবিশ্বাসী থাকে না। কিন্তু ধর্মোপাসকরা খালি বিশ্বাস-টিশ্বাসের কথা বলেন, আর লোকে মোটেই তা বিশ্বাস করতে চায় না।

 

যারা নিজেদের ভগবান বানিয়ে তুলতে চায়, তারা চিরকালের মতো নিপাত যাক।

 

ধর্ম নিয়ন্ত্রক নয়, সে উৎসাহিত করে অপরাধকে। প্রতিটি ধর্মই প্রায়শ্চিত্তকরণের ওপর স্থাপিত।

 

বল ও দুর্বলতা বিন্যস্ত করে জগৎসংসারকে। যদি শুধুই বল থাকত, তা হলে লোকে লাগাতার মারামারি করে যেত। কিন্তু ঈশ্বর আমাদের দিয়েছেন দুর্বলতা : তাই পৃথিবীকে গড়ে তুলেছে গাধা, যে বোঝা বহন করে, এবং মানুষ, যে তার ঘাড়ে বোঝা চাপায়।

 

আমাদের ধর্ম আবশ্যক, কিন্তু পুরোহিতে বিশ্বাস আবশ্যিক নয়। ঠিক যে-ভাবে স্বাস্থ্যবিধিসম্মত খাদ্য আবশ্যক, কিন্তু চিকিৎসকে বিশ্বাস আবশ্যিক নয়।

 

ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে ধর্ম হল বিবেক-সংক্রান্ত বিষয়, রাজা ও প্রজার মধ্যে তা প্রশাসনিক বিষয়, আর দুটি ব্যক্তির মধ্যে তা ধর্মান্ধতা বা প্রবঞ্চনার বিষয়।

 

মানুষ দুশ্চরিত্র হিসাবে জন্মায় না। সব শিশুই সরল, সব তরুণই বন্ধুত্বের প্রতি বিশ্বস্ত ও উদার, সব দম্পতিই ভালোবাসে তাদের সন্তানকে, সমস্ত হৃদয়েই বিরাজ করে করুণাসুধা : কেবল অত্যাচারী শাসকই দূষিত করে জগৎ। পুরোহিত সম্প্রদায় উদ্ভাবিত হয়েছে অত্যাচারী শাসকের বিরোধী হিসাবে। কিন্তু কার্যত তারা আরও খারাপ। তা হলে মানুষের জন্য আর রইল কী? দর্শন।

 

নির্বোধেরা খ্যাতিমান লেখকের সব রচনারই প্রশংসা করে।

 

রাজনীতির খুঁটিনাটি আর কলকাঠি একদিন বিলীন হয় বিস্মৃতি-সাগরে। কিন্তু পাকা আইন, বুনিয়াদি প্রতিষ্ঠান এবং বিজ্ঞান ও শিল্পকলায় সাফল্য থেকে যায় চিরকাল।

 

সমাজে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ব্যক্তির ভূমিকা ঠিক সেটাই যা সেনাবাহিনীতে কাপুরুষের, উভয়ই আপন আতঙ্কপীড়া দ্বারা বাকি সবাইকে সংক্রমিত করে।

 

আত্মা কোন্ বস্তু দ্বারা গঠিত সে-ব্যাপারে ধর্মের বিশেষ মাথাব্যথা নেই, যতক্ষণ পর্যন্ত তা পুণ্যাত্মা। এ যেন একটা ঘড়ি আপনাকে দেওয়া হল দেখভালের জন্য, কিন্তু কারিগর এটা জানাল না যে ঘড়ির চাবি কী দিয়ে বানানো।

 

যত কম অন্ধবিশ্বাস, তত কম বাদানুবাদ; যত কম বাদানুবাদ, তত কম দুর্ভাগ্য: এ কথা যদি সত্য না হয়, তবে আমরাই ভুল।

 

আমরা যেরকমটি চাই পৃথিবী যদি তেমনটিই হত— যদি সর্বত্র মানুষ খুঁজে পেত জীবিকানির্বাহের সহজ ও নিশ্চিত উপায়, এবং তাদের স্বভাবপ্রকৃতির অনুকূল জলবায়ু— তবে একজন মানুষের পক্ষে আর-একজনকে অবদমিত করা স্পষ্টত অসম্ভব হত। পৃথিবী কানায়-কানায় হোক শস্যশ্যামল; এমন সুনির্মল বায়ু বিরাজ করুক সর্বত্র যাতে কোন ব্যাধি এবং অকালমৃত্যু না ঘটে; যেন একটি হরিণের তুলনায় অধিক আশ্রয়স্থল প্রয়োজন না পড়ে মানুষের— এরকম একটা অবস্থা হলে চেংগিজ খান আর তৈমুর লং-দের আপন সন্তানসন্ততি ছাড়া আর কোন অনুচর-অনুগামীর দরকার হবে না, এরাই তাদের বৃদ্ধ বয়সে রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবে।

 

কুসংস্কারের সঙ্গে ধর্মান্ধতার সম্পর্ক ঠিক সেরকম, যেরকম জ্বরের সঙ্গে প্রলাপের, আর ক্রোধের সঙ্গে উন্মত্ততার।

 

ধর্মান্ধতা একবার যদি মগজে পৌঁছয়, তবে সে-ব্যাধি দুরারোগ্য।

 

দর্শনশাস্ত্রের প্রভাবে চিত্ত প্রশান্ত হয়, এবং ধর্মান্ধতা ও প্রশান্তির সম্পর্ক আদায়-কাঁচকলায়।

 

জ্ঞানীর আর-এক মস্ত দুর্ভাগ্য হল, সাধারণত তিনি বিচ্ছিন্ন। একজন নাগরিক কিনে নিতে পারে একটি সরকারি চাকরি, পরিবারের লোকজন দেখভাল করে তার। যদি কোন অন্যায় অবিচার হয় তার প্রতি, পাশে দাঁড়ানোর মতো জুটে যায় দু-চারজন। কিন্তু জ্ঞানীর সাহায্যকারী কেউ নেই, তাঁর অবস্থা উড়ুক্কু মাছের মতো; বেশি উঁচুতে উড়লে পাখিতে খেয়ে নেবে, জলের গভীরে ডুবলে অন্য মাছে গিলে খাবে।

 

আত্মিক অতিমারীর মোকাবিলায় আইন ও ধর্ম যথেষ্ট নয়। বিশেষত ধর্ম, উপযুক্ত পুষ্টি জোগানোর পরিবর্তে, ব্যাধিগ্রস্ত মনকে আরও বিষিয়ে তোলে।

 

প্রশ্ন : জগতে দীর্ঘতম ও হ্রস্বতম, দ্রুততম ও ধীরতম, সর্বাধিক বিভাজ্য এবং সর্বাধিক প্রসারযোগ্য, সর্বাধিক অবহেলিত এবং সর্বাধিক অনুতাপের হেতু, যা ছাড়া কিছুই সম্পন্ন হয় না, যা যাবতীয় ক্ষুদ্র বস্তুকে গ্রাস করে, এবং উজ্জীবিত করে যা-কিছু মহান— তা কী?

উত্তর : সময়। তা থেকে কিছুই দীর্ঘ নয়, কারণ তা অনন্তের মাপকাঠি; তা থেকে হ্রস্ব নয় কিছুই, কারণ আমাদের কোন কর্মপরিকল্পনারই পক্ষে তা পর্যাপ্ত নয়; যে অপেক্ষারত তার কাছে আর কিছুই অধিক ধীরগতিসম্পন্ন নয়, এবং যে উপভোগ করে তার কাছে আর কিছুই অধিক দ্রুতগতি নয়; তাকে বিভাজন করা যায় অগণ্য মুহূর্তে, তাকে প্রসারিত করা যায় অসীমতায়; সকলেই তাকে অবহেলা করে, সে বয়ে গেলে অনুতপ্ত হয় সকলেই; কোন কিছুই তাকে ছাড়া সম্পন্ন করা সম্ভব নয়; যা কিছু ক্ষুদ্র ও অকিঞ্চিৎকর
তা সবই হারিয়ে যায় এর অতলে; যা কিছু মহৎ এরই দ্বারা লাভ করে অমরত্ব।

 

কাকাঁবো জিজ্ঞেস করে, “আশাবাদ কী?”

কাঁদিদ-এর জবাব, “হায়! নিজের দুর্দশা সত্ত্বেও সব কিছু যে ঠিকঠাক চলছে জগৎসংসারে— এই ধারণার বাতিকই আশাবাদ।”

 

কতই-না মধুর হত সে-জীবন যদি তা কাটানো যেত ঈর্ষাহীন জনাকয়েক প্রতিভাবান জ্ঞানীর সঙ্গে।

 

সত্যের কোন দলীয় নাম নেই।

 

কখনওই ধরে নেবেন না যে অর্থ সব কিছু করতে পারে, নয়তো শেষমেশ আপনাকেই অর্থের জন্য সব কিছু করতে হবে।

 

টাকাপয়সার প্রশ্নে সকলেরই ধর্ম অভিন্ন।

 

ইচ্ছাকৃত মিথ্যাভাষণ ছাড়া রাজনীতি আর কী-ই বা?

 

সাধারণ ভাবে সরকার পরিচালনার কৌশল হল জনগণের এক অংশের থেকে অর্থ লুটে আর-এক অংশকে দেওয়া।

 

‘অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা’ কথাটি সম্পর্কে সাবধান, কারণ এটি শোষকেরা বলে আসছে চিরকাল।

 

গত চল্লিশ বছর যাবৎ লেখাপড়া করছি, যা বলা যেতে পারে চল্লিশটা বাতিল বছর; অপরকে শেখাই কিন্তু নিজে জানি না কিছুই। এই অবস্থার কারণে আমার মন লজ্জায় ঘৃণায় এতটাই ভরে উঠেছে যে জীবনটা অসহ্য বোধ হয়। কালপ্রবাহে আমার জন্ম, বেঁচে রয়েছি কালপ্রবাহে, কিন্তু জানি না কাল কী। দুটি অনন্তের মধ্যবর্তী একটি বিন্দুতে আমার অবস্থান, যেমনটি পণ্ডিতেরা বলে থাকেন, যদিও অনন্ত সম্পর্কে আমার কোন ধারণা নেই। বস্তু দ্বারা আমি গঠিত জানি, কিন্তু আজও আবিষ্কার করতে পারিনি কীসের থেকে চিন্তার জন্ম। যেভাবে হাত দিয়ে জিনিস ধরি ঠিক সেভাবেই মাথা দিয়ে চিন্তা করি কি না। আমার চিন্তার উৎস যে শুধু অজানা তা-ই নয়, আমার অঙ্গসঞ্চালনের উৎপত্তি-ও অজানা। জানি না আমার অস্তিত্বের কারণ। তবু প্রতিদিন লোকে এসব ব্যাপারে আমাকে প্রশ্ন করে। আমাকে উত্তর দিতেই হয়, যদিও বলার মতো কিছুই নেই; আর তাই বকবক করে যেতে হয়, আর তারপর এত বকবকানির জন্য বিভ্রান্ত বোধ করি, লজ্জা হয় নিজের ওপর।

 

কোলাব্যাঙের কাছে সৌন্দর্য কী? এমন এক ব্যাঙনি যার চোখ-দুটি ঠিকরে বেরোচ্ছে, মুখ ইয়া চওড়া, পেটটা হলদে, আর পিঠভরতি ফুটকি।

 

দর্পণ এক মূল্যহীন উদ্ভাবন। নিজেকে ঠিকঠাক দেখতে হলে অন্যের চোখে আপনার প্রতিফলন দেখুন।

 

সূত্র :

বইপত্তর-প্রকাশিত শান্তনু গঙ্গোপাধ্যায়ের তরজমায় “ভলতের : নিজের বাগান চাষ অনুচিন্তন ও কথিকা” থেকে নির্বাচিত কিছু অংশ।

বইটি কেনা যাবে এই লিঙ্ক থেকে : https://www.boipattor.in/product/nijer-bagan-chash/

Leave a Reply

Shop
Sidebar
0 Wishlist
0 Cart